মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র
পদমদী, নবাবপুর, বালিয়াকান্দি, রাজবাড়ী
উনিশ শতকের এক সব্যসাচী সাহিত্যশিল্পী যিনি তাঁর সারস্বত কৃতি-কীর্তির উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ রচনায় তিনি মীর মশাররফ হোসেন। মশাররফ রচিত ‘বিষাদ সিন্ধু’ (১৮৮৫) ও ‘জমীদার দর্পণ’ (১৮৭৩) বই দুটি জনপ্রিয়তার উত্তাল ঊর্মির তালে খেয়া বেয়ে চলছে নিরবধি। মুক্ত মন, উদার শিল্পদৃষ্টি, সমাজমনস্কতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁর জীবন ও সাহিত্যচর্চায় প্রতিফলিত হয়েছে উজ্জ্বল সত্যের উন্মুক্ত আলোকে।
মীর মশাররফ হোসেনের স্মৃতিকে ধারণ করে রাজবাড়ীসহ আশেপাশে কয়েকটি জেলার মানুষের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের বোধ ও জ্ঞানের বিকাশ ঘটবে এমনই লক্ষ ও উদ্দেশ্য নিয়ে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের পদমদী গ্রামে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাংলা একাডেমি স্মৃতিকেন্দ্রটি সার্বিকভাবে পরিচালনা করছে। মীর মশাররফ হোসেন ও তাঁর স্ত্রী বিবি কুলসুম, ভাই মীর মোকাররম হোসেন ও মোকাররম হোসেনের স্ত্রী বিবি খোদেজার সমাধি ঘিরে নৈসর্গিক পরিবেশে স্থাপিত স্মৃতিকেন্দ্রটি। মূল ভবন পেরিয়ে সমাধিসৌধের দিকে পা বাড়ালেই চোখে পড়বে ব্রোঞ্জের তৈরি সাহিত্যিকের দৃষ্টিনন্দন আবক্ষ ভাস্কর্য। স্মৃতিকেন্দ্রে রয়েছে বাংলা একাডেমির একটি বই বিক্রয়কেন্দ্র, সেমিনার কক্ষ, প্রামাণ্য সংগ্রহশালা, সুসজ্জিত ও সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার, পাঠাগার, বিশেষ অতিথি কক্ষ ইত্যাদি।
এমন একটি নান্দনিক স্থাপনাকে ঘিরে দর্শনার্থীদের জ্ঞানার্জনের প্রচণ্ড আকাঙ্খা পূরণ করছে স্মৃতিকেন্দ্রের গ্রন্থাগার। প্রতিদিন স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীসহ নানা বয়সের জ্ঞানপিপাসু মানুষ গ্রন্থাগারে আসেন এবং জ্ঞান অন্বেষণ করেন। দর্শনার্থীরা স্মৃতিকেন্দ্রের প্রতিটি কোনায় কোনায় মীর মশাররফ হোসেনকে খুঁজে পান বহুমাত্রিক তথ্য ও উপাত্তে। প্রবেশের প্রথম পদক্ষেপ থেকেই সাহিত্যিককে জানার নানা উপকরণে সজ্জিত স্মৃতিকেন্দ্র প্রাঙ্গণ। স্মৃতিকেন্দ্রে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত সকল বই পঁচিশ শতাংশ কমিশনে বিক্রি হয়। বাংলা একাডেমির এই উদ্যোগ পাঠকদেরকে গুণগত মানের বই প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
সংস্কৃতির মধ্যে যে অনুশীলনজাত মননগত উৎকর্ষ ও মূল্যবোধ রয়েছে তা-ই মানবসম্পদের উন্মেষ ঘটায়। সংস্কৃতি মানুষের জীবনযাপনের মূলসূত্র নির্ধারণ করে। একটি জাতির জনগোষ্ঠীর মান পরিমাপ করা যায় সে জাতির সাহিত্য সংস্কৃতি পর্যালোচনা করে। বিদগ্ধ সাহিত্যজন মীর মশাররফ হোসেনের স্মৃতি বিজড়িত প্রতিষ্ঠানটিকে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় বিশেষায়িত হিসেবে গড়ে তুলতে বাংলা একাডেমি বহুমাত্রিক উদ্যেগ গ্রহণ করেছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯-এ প্রথমবারের মত এখানে তথ্যকেন্দ্র চালু ও বই বিক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। গ্রামীণ পরিবেশে এমন আয়োজন মানুষের চিত্তাকর্ষণ করে। স্মৃতিকেন্দ্রের সংগ্রহশালাটি সাজানো হয়েছে সাহিত্যিকের বিভিন্ন উক্তি ও তাঁর সাথে প্রাসঙ্গিক ও রূপক ছবি ফ্রেমে বাঁধাই করে। এছাড়া লেখকের স্বাক্ষর, লেখকের কবিতা (যা তিনি লিখেছিলেন স্ত্রী বিবি কুলসুমের প্রয়াণে কাতর হয়ে) ইত্যাদি প্রদর্শন করা হয় সংগ্রহশালাতে।
প্রতিবছর ১৩ই নভেম্বর সাহিত্যিকের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি স্মৃতিকেন্দ্রে দিনব্যাপী আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। অনুষ্ঠানটি অত্র এলাকার মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় ও কাঙ্ক্ষিত। দিনটিতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই স্মৃতিকেন্দ্রে আসে ও অনুষ্ঠান উপভোগ করে। স্মৃতিকেন্দ্রের বাহিরে হরেক রকমের জিনিসপত্র ও খাবারদাবারের পশরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা। এক কথায় সাহিত্যিকের জন্মাবার্ষিকী এই অঞ্চলের মানুষের জন্য এক বিশেষ পার্বণ। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র সচেতন রয়েছে। স্মৃতিকেন্দ্রেটি দোয়েল, কোকিল, বউ কথা কও, ঘুঘু, হুতুম পেঁচা, কাঠঠোকরা, কাঠবিড়ালীদের অভয়ারণ্য। ঝাউ গাছে বাসা বাঁধে ঘুঘু পাখি। ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফোঁটায়। স্মৃতিকেন্দ্রটি তাদের নিরাপদ ঠিকানা। স্মৃতিকেন্দ্র সারাদিন মুখরিত থাকে বউ কথা কও পাখির ডাকে। এছাড়া স্মৃতিকেন্দ্রের গাছে ধরা নানা প্রজাতির ফল খেতে কাঠবিড়ালীদের সারাদিনের যে ব্যস্ততা তা দেখলে যে কারো মনোরঞ্জণিত হতে বাধ্য।
সবুজ ঝাউগাছে ঘেরা সমাধিসৌধ যদি পাখির চোখে দেখা হয় তাহলে মনে হয় যেন সবুজ আর সাদা মিলেমিশে এক নতুন রঙের সৃষ্টি হয়েছে। সে সৌন্দর্য শুধু চোখ মেলে দেখা যায়, সে সৌন্দর্য্যে স্নিগ্ধ হওয়া যায়, তবে বর্ণনা করা যায় না। সবুজ ঘাসের বুকে চারটি সমাধি সারিবদ্ধভাবে অবস্থিত। সমাধির ভেতরে লাল পাতার বাহারি গাছ সমাধিগুলোকে জড়িয়ে আছে পরম মমতায়। দর্শনার্থীরা লাল আর সবুজের মাঝে চিরশায়িত সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের স্মৃতিকে খুঁজে ফেরে প্রতিদিন। আগামীতে স্মৃতিকেন্দ্রে একটি গানের স্কুল ও একটি চিত্রাঙ্কণের স্কুল চালু করার বিষয়ে বাংলা একাডেমির সদিচ্ছার প্রেক্ষিতে স্থানীয় পর্যায়ে জনমত জরিপ করে আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া গেছে। পাঠাগার কার্যক্রমের পাশাপাশি গান ও চিত্রাঙ্কণের স্কুল চালু করা গেলে অত্র এলাকায় মানবসম্পদ উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্মেষপর্বের শুভ সূচনা হবে।
সর্বোপরি, মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র সারাদিনের কর্মব্যস্ত মানুষের জীবনে একটুখানি প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাওয়ার জায়গা। সব বয়সের, সব শ্রেণি-পেশার মানুষ স্মৃতিকেন্দ্রটিকে উপভোগ করে নিজস্ব আঙ্গিকে। তবে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী সাহিত্যিকের জীবন ও সাহিত্য গবেষণা এবং বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি গবেষণার মাধ্যমে হতে পারে দেশের প্রণিধানযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান। সে লক্ষ্যেই বাংলা একাডেমির ধারাবাহিক ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সৃজনশীল নীতিমালা, কর্মকাণ্ড ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে নবযুগের নবপ্রভায় উদ্ভাসিত হতে যাচ্ছে বাংলা একাডেমি পরিচালিত মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র।
পরিদর্শন সময়সূচি
স্মৃতিকেন্দ্র : প্রতিদিন সকাল ৯.৩০টা থেকে ৫.০০টা (বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক বন্ধ)
বই বিক্রয়কেন্দ্র : ১০.০০টা থেকে ৪.৩০টা
গ্রন্থাগার : ১০.০০টা থেকে ৪.৩০টা
যেভাবে আসা যায়
ঢাকা থেকে (গাবতলী বাস টার্মিনাল) সড়কপথে এসি অথবা নন-এসি বাসে যাতায়াত করা যায়। ঢাকা থেকে রাজবাড়ীর দূরত্ব ১২০ কি.মি.। গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে রাবেয়া পরিবহন, রোজিনা পরিবহন, লালন পরিবহন, সৌহার্দ পরিবহনে করে রাজবাড়ী আসা যায়। রাজবাড়ী পর্যন্ত এসি বাসের ভাড়া ৫০০.০০ (পাঁচশত) টাকা এবং নন-এসি বাসের ভাড়া ২৫০.০০ ( দুইশত পঞ্চাশ) টাকা। রাজবাড়ী সদর থেকে ইজিবাইক অথবা স্কুটারযোগে বহরপুর বাজার হয়ে নবাবপুর ইউনিয়নের পদমদী গ্রামে অবস্থিত মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্রে সরাসরি আসা যায়। পথভাড়া ৯০.০০(নব্বই) টাকা। এছাড়া রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা শহর থেকে আনন্দবাজার হয়ে স্মৃতিকেন্দ্রে আসা যায়। পথভাড়া ২৫.০০(পঁচিশ) টাকা।
যোগাযোগ : ০১৭৪২-৬৬৭২৫৫, ০১৭৭১-০৩৮২২১
বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র
পায়রাবন্দ, রংপুর
নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম রংপুর মহানগর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে মিঠাপুকুর উপজেলার ঐতিহাসিক স্থান পায়রাবন্দ ইউনিয়নের খোর্দ্দমুরাদপুর গ্রামের এক জমিদার পরিবারে ১৮৮০ সালে। অনন্ত নক্ষত্রে পাড়ি ১৯৩২ সালে। রোকেয়ার জন্ম আর চলে যাওয়া দুটোই ৯ই ডিসেম্বর।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা সাহিত্যে একটি অনন্য সাধারণ নাম। তাঁর স্মৃতি আর কর্মকে ধরে রাখার জন্য বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি পরিচালিত হয় বাংলা একাডেমির প্রশাসন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগের অধীনে। এছাড়াও বাংলা একাডেমি ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র সংস্কার ও আধুনিকায়ন’ একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে যা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সবুজ পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রকল্পটির মেয়াদকাল তিনবছর। প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছাত্র-ছাত্রী, লেখক, গবেষক এবং নারী সমাজকে কারিগরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান চর্চা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন নারীকে সাবলম্বী হিসেবে তৈরি করা। এছাড়াও স্মৃতিকেন্দ্রে স্বল্প পরিসরে সংগীত ও চিত্রাঙ্কন প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের জমির পরিমাণ ৩ একর ১৫ শতাংশ। সুদৃশ্য ঘাটসহ একটি পুকুর আকৃষ্ট করে দর্শনার্থীদের। মূলভবনে অফিস কক্ষ, সেমিনার কক্ষ, প্রশিক্ষণ কক্ষ, গবেষণা কক্ষ, সংগ্রহশালা, গ্রন্থাগার, অডিটরিয়াম ছাড়াও রয়েছে অতিথিশালা, প্রতিষ্ঠান প্রধানের ভবন এবং তিনতলা আবাসিক ভবন।
স্মৃতিকেন্দ্রের অভ্যন্তরে রয়েছে ব্রোঞ্জের তৈরি রোকেয়ার ভাস্কর্য। এমন একটি নান্দনিক স্থাপনাকে ঘিরে দর্শনার্থীদের জ্ঞানার্জনের প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা পূরণ করছে স্মৃতিকেন্দ্রের গ্রন্থাগার। স্মৃতিকেন্দ্রের গ্রন্থাগারে রয়েছে ২,২০৯ (দুই হাজার দুইশত নয়) টি বই। প্রতিদিন অসংখ্য পাঠকের সমাগম ঘটে।
প্রতিবছর ৯ থেকে ১১ই ডিসেম্বর রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তিন দিনব্যাপী পায়রাবন্দে ‘রোকেয়া মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা একাডেমি প্রথম দিন আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।
স্মৃতিকেন্দ্রের অডিটরিয়াম, সেমিনার কক্ষ এবং প্রাঙ্গণ বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে ভাড়া পরিশোধ ও জামানত প্রদানের মাধ্যমে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার সুযোগ রয়েছে।
অফিস ও স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রমের সময়সূচি:
প্রতিদিন সকাল ৯.০০টা থেকে বিকাল ৫.০০টা
সাপ্তাহিক বন্ধ: শুক্রবার ও শনিবার এবং সরকারি ছুটির দিন
যোগাযোগ : ০১৭১৩৪৫২৮৬৯ (ঢাকা), ০১৭১৪৩৩৩৯৩৩ (রংপুর)