গবেষণা উপবিভাগের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রথম সরকারি ঘোষণায় প্রাথমিকভাবে গবেষণা ও অনুবাদ শাখা নিয়ে অভিযাত্রা শুরুর নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে বাংলা একাডেমি ৪টি বিভাগে বিন্যস্ত হয়, যথা-গবেষণা, অনুবাদ, সংকলন ও প্রকাশন এবং সাংস্কৃতিক বিভাগ। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই গবেষণা কার্যক্রমকে বাংলা একাডেমির মৌলিক কাজ হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। বিশেষ করে বাংলা ভাষার উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, শব্দ ও ধ্বনিবিজ্ঞান, ভাষার ইতিহাস, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, দর্শন, সমাজনীতি, ধর্ম, বিজ্ঞান ও জাতীয় সংস্কৃতি প্রভৃতি বাংলা একাডেমির গবেষণার অভিলক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একই সঙ্গে প্রাচীন হস্তলিখিত পুথির পাণ্ডুলিপি, লোকসংগীত, লোকগাথা প্রভৃতি সংগ্রহের পাশাপাশি বাংলা বানান, ব্যাকরণ সংস্কার প্রভৃতি কার্যপরিধি বাংলা একাডেমির গবেষণা শাখার কর্মপরিধি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠার কিছু কালের মধ্যে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলা একাডেমির গবেষণা শাখা বাংলাদেশের গবেষণার মান-উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা-বৃত্তি প্রদান শুরু করে। এমনকি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কাব্য-পাঁচালি প্রকাশেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। উল্লেখ্য, বাংলা একাডেমির গবেষণা বিভাগ ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমির প্রথম গ্রন্থ আহমদ শরীফ সম্পাদিত দৌলত উজির বাহরাম খাঁর 'লায়লী-মজনু' প্রকাশ করে।
উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বাংলা একাডেমিতে গবেষণা একটি স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদা নিয়ে কাজ শুরু করলেও বিভিন্ন কাল-পর্বে তা নানাভাবে বিন্যস্ত হয়। যেমন, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমির গবেষণা ও সংকলন বিভাগ একীভূত হয়। ফলে, গবেষণা বিভাগের মর্যাদা থেকে উপবিভাগে পরিণত হয়। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমির গবেষণা উপবিভাগ প্রধান সামরিক আইন প্রকাশকের নির্দেশে গবেষণা, সংকলন ও ফোকলোর বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়। সর্বশেষ বাংলা একাডেমি আইন ২০১৩ অনুযায়ী গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগের অধীনে গবেষণা উপবিভাগ সক্রিয় রয়েছে। বর্তমানে গবেষণা উপবিভাগের অধীনে রয়েছে ৩টি শাখা-১. শহীদুল্লাহ্ গবেষণা-কক্ষ, ২. বাংলা একাডেমি পুথিসংগ্রহশালা এবং ৩. নজরুল স্মৃতিকক্ষ।
শহীদুল্লাহ্ গবেষণা-কক্ষে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় দুষ্প্রাপ্য পত্রিকা, দুর্লভ গ্রন্থ প্রভৃতি সংরক্ষিত রয়েছে। অন্যদিকে বাংলা একাডেমি পুথি সংগ্রহশালায় মধ্যযুগের প্রায় ২৫০০টি হস্তলিখিত দুর্লভ পাণ্ডুলিপি এবং শতাধিক দুষ্প্রাপ্য মুদ্রিত পুথি সংরক্ষিত রয়েছে। শহীদুল্লাহ গবেষণা-কক্ষ এবং বাংলা একাডেমি পুথিসংগ্রহশালায় সংরক্ষিত উপর্যুক্ত উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহু গবেষক-অধ্যাপক গবেষণা সম্পাদন করেছেন। এছাড়া, নজরুল স্মৃতিকক্ষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচিত গ্রন্থের পাশাপাশি নজরুলের জীবন ও সাহিত্য-কর্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রকাশিত নানা ধরনের গ্রন্থ গবেষক, পাঠক ও দর্শনার্থীদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে।
বাংলা একাডেমির গবেষণা উপবিভাগ নানা ধরনের গ্রন্থ প্রকাশনার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত তহবিল কর্তৃক পরিচালিত ৩টি গবেষণা-বৃত্তি প্রদানের সামগ্রিক কর্মসম্পাদন করে। বাংলা একাডেমির গবেষণা উপবিভাগ পরিচালিত ৩টি গবেষণা-বৃত্তি হলো-২০০২ খ্রিষ্টাব্দে থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের লক্ষ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংক ফাউন্ডেশন প্রদত্ত মার্কেন্টাইল ব্যাংক গবেষণা গবেষণা-বৃত্তি; শিশু সমীক্ষা, বাংলা ভাষা উন্নয়ন ও শিক্ষা বিষয়ে প্রদত্ত ফেরদাউস-খাতেমন গবেষণা ফান্ড এবং ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আইন, আইন-দর্শন, বাংলা ভাষায় আইনের ব্যবহার, ইসলাম ও মানবাধিকার বিষয়ে প্রদত্ত গাজী শামছুর রহমান স্মৃতি গবেষণা তহবিল।
বাংলা একাডেমির গবেষণা উপবিভাগ বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণা-গ্রন্থের পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, সমাজ, ভূগোল, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়ক গবেষণা-ধর্মী গ্রন্থ বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের জীবনী-গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশ করে আসছে।
গবেষণা উপবিভাগের অধীন গবেষণা কক্ষসমূহ:
গবেষণা উপবিভাগের আওতাধীন বর্ধমান হাউসে জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর স্মৃতিবিজড়িত 'শহীদুল্লাহ গবেষণা- কক্ষ', 'বাংলা একাডেমির পুথি-সংগ্রহশালা' এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত 'নজরুল স্মৃতিকক্ষ' রয়েছে। এই কক্ষগুলির উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নিম্নরূপ:
ক. শহীদুল্লাহ্ গবেষণা কক্ষ
বাংলা একাডেমির স্বপ্নদ্রষ্টা জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-র প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ বাংলা একাডেমির গবেষণা উপবিভাগের অধীন 'শহীদুল্লাহ গবেষণা-কক্ষ' উন্মুক্ত রয়েছে। কক্ষটিতে আনুমানিক প্রায় ৫ শতাধিক বিভিন্ন ধরনের দুর্লভ গ্রন্থসহ প্রায় ৭৭ ধরনের কয়েক শত দুষ্প্রাপ্য দৈনিক, অর্ধ-সাপ্তাহিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা সংরক্ষিত রয়েছে। শহীদুল্লাহ্ গবেষণা-কক্ষে সংরক্ষিত দুষ্প্রাপ্য মাসিক পত্রিকার মধ্যে সওগাত, বসুমতি, মোহাম্মদী, দিলরুবা, নওবাহার প্রভৃতি বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ফোকলোর গবেষণার অমূল্য উপাদান হিসেবে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের গবেষণাগণ ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া নিয়মিত বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গবেষণা কক্ষটি পরিদর্শন করেন।
খ. বাংলা একাডেমি পুথি-সংগ্রহশালা
বাংলা একাডেমির পুথিসংগ্রহশালায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন ভাষা ও লিপির প্রায় আড়াই সহস্রাধিক হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে। মধ্যযুগের বাংলা ভাষার কাব্য, পাঁচালি প্রভৃতির পাশাপাশি সংস্কৃত ও আরবি ভাষার পাণ্ডুলিপিও সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া, আরবি হরফে লেখা বেশ কিছু দুর্লভ বাংলা পাণ্ডুলিপি বাংলা একাডেমির পুথিসংগ্রহশালায় লভ্য। শুধু তাই নয়, বাংলা একাডেমির পুথিসংগ্রহশালায় প্রায় দুই শতাধিক দুষ্প্রাপ্য মুদ্রিত পুথি, দুর্লভ গ্রন্থ ও পঞ্জিকা সংরক্ষিত রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের বহু গবেষক বাংলা একাডেমির পুথিসংগ্রহশালার হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত পুথি নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেছেন।
গ. নজরুল স্মৃতিকক্ষ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত বর্ধমান হাউসের দ্বিতীয় তলায় গবেষণা উপবিভাগের অধীন 'নজরুল স্মৃতিকক্ষ' গবেষকদের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। একই সঙ্গে কক্ষটিতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নিজস্ব সৃষ্টিকর্ম তথা কাব্য, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, গান ও চিঠিপত্রের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হচ্ছে। এছাড়া, নজরুলের জীবন ও কর্ম বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা-গ্রন্থ, পোস্টার, আলোকচিত্র প্রভৃতি কক্ষটিতে সংরক্ষিত রয়েছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গবেষক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের কর্মী এবং স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায় নিয়মিতভাবে নজরুল স্মৃতিকক্ষ পরিদর্শন করেন। বাংলা একাডেমি নজরুল স্মৃতিকক্ষ নিজস্ব সংগ্রহের ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে রেফারেন্স সেবাও প্রদান করে। সার্বিকভাবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টিকর্মকে অনুধাবন এবং চর্চার ক্ষেত্রে নজরুল স্মৃতিকক্ষ সহায়ক।