সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ১st সেপ্টেম্বর ২০২৪
ইতিহাস ও কার্যাবলি
বাংলা একাডেমি : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পরই পূর্ব বাংলায় শুরু হয় বাঙালির জাতিসত্তা ও মাতৃভাষার অধিকারের ওপর আক্রমণ। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে রমনা রেসকোর্স ময়দানে (এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বলেন ‘Urdu and only urdu shall be the state language of Pakistan'. এই বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্ররা চিৎকার করে বলেন ‘No, No’ সেই মুহূর্তেই রোপিত হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার বীজ; এবং ধাপে ধাপে সমান্তরালভাবে নানা ঐতিহাসিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলন ১৯৪৮-এ শুরু হয়ে ১৯৫২-এ ছাত্রজনতার আত্মবলিদানে ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের সূচনা করে। এর পরই ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি সামরিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর নিগড় থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালি তার ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ও নিজস্ব জাতিসত্তাভিত্তিক একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সূচনা করে।
এই লক্ষ্যে ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষ্যে এ. কে. ফজলুল হক-মওলানা ভাসানী এবং সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত হয় রাজনৈতিক মোর্চা : ‘যুক্তফ্রন্ট’। এঁদের ২১ দফা নির্বাচন ইশতিহারের ১৬ নং ধারায় বলা হয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা, উন্নয়ন, প্রচার এবং প্রসারের জন্য একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার কথা। ঐ নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক সরকারি দল মুসলিম লীগকে ভ‚মিধস বিজয়ে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন এবং বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা তাই একই ইতিহাসের ওতপ্রোত অংশ।
রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরার এমন নিবিড় সংশ্লিষ্টতা বাংলাদেশের আর কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। এজন্যই বাংলা একাডেমি বাঙালি জাতির অনন্য গৌরবধন্য আধুনিক ও সেক্যুলার রাষ্ট্রসত্তা, জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক। বাংলা একাডেমিকে তাই শুধু ‘জাতির মননের প্রতীক’ বললে এর সংগ্রামী ইতিহাসকে কৌশলে অস্পষ্টতার আবরণে ঢেকে দেওয়া হয়।
১৯৫৫ সালের ২৬শে নভেম্বর নবনির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকার বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্যে একটি ‘আয়োজক সমিতি’ (Preparatory Committee) গঠন করে প্রথমে জহিরুল ইসলাম ও পরে সাহিত্যিক ও সরকারি কর্মকর্তা মোহম্মদ বরকতুল্লাহ্কে একাডেমির স্পেশাল অফিসার (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) নিযুক্ত করা হয়। গবেষণা, অনুবাদ, সংকলন ও প্রকাশনা এবং সংস্কৃতি-এই চারটি বিভাগ নিয়ে বাংলা একাডেমি কাজ শুরু করে।
১৯৫৬ সালের ১লা ডিসেম্বর ড. মুহম্মদ এনামুল হক বাংলা একাডেমির প্রথম পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর এ প্রতিষ্ঠান তার একাডেমিক চরিত্র ও দিক-নির্দেশনা যেমন লাভ করে তেমনি ১৯৫৭ সালে ৩রা এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে ‘দি বেঙ্গলি একাডেমী অ্যাক্ট ১৯৫৭’ পাশ করে এর আইনগত ভিত্তি দেওয়া হয়। এই আইনে বাংলা একাডেমিকে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা প্রদান করা হয়। ১৮ই মে ১৯৫৭ তারিখে অনুষ্ঠিত ১০ম সভায় আয়োজক সমিতি বিভাগসমূহের পুনর্বিন্যাস করে ৬টি বিভাগ গঠন করেন। পুনর্গঠিত বিভাগগুলো ছিল নিম্নরূপ : ১. গবেষণা বিভাগ; ২. অনুবাদ বিভাগ; ৩. সংকলন বিভাগ; ৪. প্রকাশন ও বিক্রয় বিভাগ; ৫. সংস্কৃতি বিভাগ; এবং ৬. গ্রন্থাগার বিভাগ। ১০ই আগস্ট ১৯৫৭ তারিখে উক্ত আইন বলবৎ হয়।
এই আইনে ‘বাংলা একাডেমি কাউন্সিল’ গঠনের বিধান থাকায় আয়োজক সমিতি বাংলা একাডেমির ‘কাউন্সিল’-এ রূপান্তরিত হয়। বাংলা একাডেমির প্রথম নির্বাচিত কাউন্সিল গঠিত হয় ২৬শে মার্চ ১৯৫৮ তারিখে। ১০ই আগস্ট ১৯৫৮ থেকে কাউন্সিল কার্যকর হয়। এই কাউন্সিলে পদাধিকারবলে ৪ জন, সরকার মনোনীত ৭ জন এবং নির্বাচিত ৮ জন সদস্যসহ মোট ১৯ জন সদস্য ছিলেন। এভাবেই বাংলা একাডেমির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু।
তবে গঠনের পরপরই পুনর্বিন্যাসকৃত বিভাগসমূহ কাজ শুরু করতে পারেনি। যেমন, গবেষণা বিভাগের প্রতিষ্ঠা ও সূচনা হয়েছিল ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অনুবাদ বিভাগ কাজ শুরু করে ১৯৬১-১৯৬২ সাল থেকে। সংস্কৃতি বিভাগ ও গ্রন্থাগার বিভাগ চালু করা হয় ১৯৫৮ সালের জানুয়ারিতে। প্রকাশন বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫৭ সালের গোড়ার দিকে।
অতঃপর ১৯৬০ সালের ২৬শে জুলাই পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ‘দি বেঙ্গলি একাডেমী (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স’ জারি করেন। এতে সভাপতি নিয়োগসহ কাউন্সিল গঠন বিষয়ে কিছু সংশোধনী আনা হয়। এ ছাড়া একাডেমির কর্মকাণ্ড পরিচালনা বিষয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ১৭ই মে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ‘দি বাংলা একাডেমী অর্ডার, ১৯৭২’ জারি করেন। এই আদেশে ‘কেন্দ্রীয় বাঙ্লা উন্নয়ন বোর্ড’ বাংলা একাডেমির সঙ্গে সমন্বিত হয় এবং কাউন্সিলের নাম পরিবর্তন করে ‘কার্যনির্বাহী পরিষদ’ করা হয়। বাংলা একাডেমির প্রধান নির্বাহী হিসেবে মহাপরিচালকের পদ সৃষ্টি করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম সমন্বিত বাংলা একাডেমির প্রথম মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। এই আদেশে বাংলা একাডেমির বিভাগসমূহ পুনর্বিন্যস্ত করে মোট ৭টি বিভাগ গঠন করা হয়। বিভাগসমূহ হচ্ছে : ১. গবেষণা ও সংকলন বিভাগ; ২. অনুবাদ বিভাগ; ৩. সংস্কৃতি বিভাগ; ৪. প্রাতিষ্ঠানিক বিভাগ; ৫. প্রকাশন, বিক্রয় ও প্রেস বিভাগ; ৬. পাঠ্যপুস্তক বিভাগ; এবং ৭. ফোকলোর বিভাগ। ১৯৭২ সালের ১৭ই মে থেকে ১৯৮৩ সালের ২৫শে মে সময়ের মধ্যে এই ৭টি বিভাগের সঙ্গে আরও ৩টি নতুন বিভাগ যুক্ত হয়ে মোট ১০টি বিভাগ হয়। নতুন বিভাগগুলি হচ্ছে (১) সংকলন বিভাগ; (২) গ্রন্থাগার বিভাগ; (৩) অর্থ ও পরিকল্পনা বিভাগ। ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ১৯৭৮ সালের ৬ই জুন ‘দি বাংলা একাডেমী অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮’ জারি করা হয়।
১৯৮৩ সালের ২৫শে মে তারিখে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের এক আদেশবলে এবং ২৬শে ডিসেম্বর এনাম কমিটি কার্যকর হওয়ার ফলে একাডেমির বিভাগসমূহের সংখ্যা ৪টিতে কমিয়ে আনা হয় এবং পরিচালকের পদমর্যাদাসম্পন্ন প্রধান গ্রন্থাগারিকের অধীনে গ্রন্থাগারকে পৃথক করা হয়। ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমির নতুন আইন পাশ হয়। এই আইনের আলোকে বাংলা একাডেমির প্রবিধানমালা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
কার্যাবলি
১. জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়ন, লালন ও প্রসার;
২. বাংলা ভাষার প্রামাণ্য অভিধান, পরিভাষা ও ব্যাকরণ রচনা, রেফারেন্স গ্রন্থ, গ্রন্থপঞ্জি এবং বিশ্বকোষ প্রণয়ন, প্রকাশন ও সহজলভ্যকরণ;
৩. বাংলা শব্দের প্রমিত বানান ও উচ্চারণ নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার ব্যাপকতর ও সমৃদ্ধতরকরণ;
৪. বাংলা ভাষায় উচ্চতর পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক রচনা করা এবং উক্ত উদ্দেশ্যে গবেষণা, অনুবাদ গ্রন্থ এবং ভাষা-আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কিত গবেষণা ও সংকলন গ্রন্থ প্রকাশকরণ;
৫. আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় বাংলা সাহিত্যকর্মের অনুবাদ এবং অন্যান্য ভাষার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থা করা;
৬. সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী তথা সকল পর্যায়ের গণকর্মচারীদের বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন, বাংলা বানানরীতি ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা।
৭. সাহিত্য পুরস্কার প্রদান এবং বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তন এবং ফেলো, জীবনসদস্য ও সদস্যপদ প্রদান;
৮. বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চা বহির্বিশ্বে প্রচার ও পরিচিতকরণ।